ছাত্রজীবন থেকে হজরত আল্লামা আতাউর রহমান খান (রহ.)-কে চিনতাম। আমি যখন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া আলিয়া মাহমুদুল উলুম মাদরাসায় দাখিল-আলিম (১৯৬৯-১৯৭৩) শ্রেণিতে অধ্যয়ন করি, তখন থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচিতি ঘটে। আমরা ছাত্ররা মাদরাসা অধ্যক্ষের মাধ্যমে করাচি থেকে দৈনিক জং, ঢাকা থেকে দৈনিক আজাদ, করাচি দারুল উলুম থেকে মাসিক আল-বালাগ, পেশোয়ারের আকোড়া খটক থেকে মাসিক আল-হক, সাপ্তাহিক নেযামে ইসলাম, কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে মাসিক ‘মুনাদী’সহ নানা ম্যাগাজিন আনার ব্যবস্থা করি। সাতকানিয়া আলিয়া ও পটিয়া আল-জামিয়া ইসলামিয়ায় অধ্যয়নকালে আমাদের শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু-আরবি। পরীক্ষার খাতায় উর্দু ভাষায় উত্তর প্রদান ছিল সাধারণ রেওয়াজ। আরবি ভাষায় উত্তর দিলেও কোনো অসুবিধা হতো না। তখন কিন্তু মাদরাসা অঙ্গনে বাংলার প্রচলন ব্যাপকতা লাভ করেনি। আমরা উর্দু-আরবি-বাংলা তিন ভাষার চর্চা করতাম। সাতকানিয়া আলিয়া মাহমুদুল উলুম মাদরাসার তৎকালীন মুহাদ্দিস, আমাদের প্রিয় উস্তাদ হজরত আল্লামা মুফতি আবদুল হালিম বুখারী ভাষাচর্চার ব্যাপারে আমাদের সর্বদা উৎসাহিত করতেন। প্রতি সোমবার জোহর নামাজের পর তিনি মাদরাসা মসজিদে ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে পর্যায়ক্রমে আরবি, বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দিতেন। আমরা এর মাধ্যমে প্রণোদনা লাভ করতাম।
সে সময় কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে হজরত মাওলানা আতাহার আলী (রহ.)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ও হজরত মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত মাসিক ‘মুনাদী’ আমাদের আকর্ষণ করত। নানা কলাম বিশেষত হজরত মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.) কর্তৃক লিখিত বিভিন্ন নিবন্ধ আমরা মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করতাম। ওলামা মাশায়েখদের মধ্যে সে সময় উন্নত রচনাশৈলীসমৃদ্ধ নিবন্ধ লেখক ছিলেন হাতে গোনা কজন মাত্র। হজরত মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.)-এর জুতসই শব্দচয়ন, শব্দের গাঁথুনি, বাক্যবিন্যাস ও উপমা উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্ব আমাদের কিশোর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখত। ধীরে ধীরে আমরা তার ভক্ত হয়ে উঠি। পরে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তার সুচিন্তিত নিবন্ধাবলি আমাদের চিন্তা ও মননের খোরাক জোগাতো। তিনি আমাদের কাছে আইকন ও আইডল। ইন্তেকালের পর চট্টগ্রাম থেকে কিশোরগঞ্জ গিয়েছি তাকে জিয়ারত করার জন্য। নিজ ঘরের আঙিনায় বেহেশতি পরিবেশে তিনি চিরনিদ্রায় সমাহিত রয়েছেন।
১৯৮০-৮২ সালে আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি, একদিন পটিয়া আল-জামিয়া ইসলামিয়ায় তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তখন তিনি তার বড় সন্তান মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। নদভী ভাই সে সময় জামিয়ায় অধ্যয়নরত ছিলেন। এরপর দীর্ঘ সময় তার সঙ্গে আমার পত্রবিনিময়, দেখা-সাক্ষাৎ ও মোবাইলে কথা হতো। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ ও আদর করতেন। একটা ব্যাপার সব সময় লক্ষ করেছি, কেউ তার কাছে চিঠি লিখলে তিনি দ্রুততম সময়ে এর উত্তর দিতে দেরি করতেন না। এ গুণটি ভারতীয় ও ইউরোপীয় স্কলারদের মজ্জাগত হলেও বাঙালিদের মধ্যে তা কদাচিৎ দেখা যায়। তার ইন্তেকালের বছরখানেক আগে খতিবে আযম হজরত আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর স্মারক গ্রন্থের জন্য একটি লেখা চেয়ে তার কাছে একটি চিঠি লিখি। কয়েক দিনের মধ্যে তিনি চিঠির জবাব দেন এবং লেখাও পাঠিয়ে দেন। লেখাটি পরে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়। নিবন্ধের শুরুতে তার দরদভরা আকুতি ও বিতৃষ্ণ মনের আহাজারি আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে।
হজরত মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.)-এর চেতনা ছিল শানিত, চিন্তা ছিল স্বচ্ছ, কথা ছিল গোছানো। তিনি একাধারে সুলেখক, ভালো বক্তা, অভিজ্ঞ একাডেমিসিয়ান, বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ও দক্ষ সংগঠক। জ্ঞানের ঐশ্বর্য, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, হৃদয়ের ঔদার্য ও মেধার বহুমাত্রিকতা তার জীবনকে মহীয়ান করে তোলে। তাফসির, হাদিস, ফিকহ, ইলমুল কালাম, দর্শন, আরবি ও উর্দু ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিল ঈর্ষণীয়। তিনি ভালো ইংরেজি ও ফারসি ভাষা জানতেন। ছাত্রজীবন থেকে সময়কে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। সময়ানুবর্তিতা তার জীবনের এক আলোকিত দিক।
তার মার্জিত ব্যবহার, পরিশীলিত আচরণ ও হৃদয়-প্রসারিত আতিথ্যপ্রীতি আমার মতো অনেককেই বাৎসল্যের বাহুডোরে আবদ্ধ করেছে গভীর নিবিড়তায়। দেশ, জাতি ও মিল্লাতের ফিকিরে তিনি সবসময় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। ইসলামি আদর্শের আলোকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তার আশৈশব লালিত স্বপ্ন। আদর্শিক মুগ্ধতার টানে কওমি ধারার আলেমদের ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি যে নিরলস খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, তা জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করবে। কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাকুল মাদারিস) মহাসচিব হিসেবে সংগঠনকে একটি শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর জন্য তার প্রচেষ্টা ছিল একনিষ্ঠ, পরিকল্পনানির্ভর ও বাস্তবভিত্তিক।
হজরত মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.) যোগ্য উত্তরসূরি রেখে গেছেন। দয়ার্দ্র মনোবৃত্তি, কঠোর নজরদারি এবং নিবিড় পরিচর্যায় তিনি তার সন্তানদের গড়ে তুলতে এবং উচ্চশিক্ষা দিতে সফলতা দেখিয়েছেন। তারা সবাই বিভিন্ন ফিল্ডে বাবার রেখে যাওয়া মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মযজ্ঞে ব্রতী রয়েছেন।
একজন দক্ষ শিক্ষাবিদ হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন জননন্দিত রাজনৈতিক নেতা। বিএনপির ব্যানারে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে কিশোরগঞ্জ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বিএনপি তাকে মূল্যায়ন করেনি। তাকে অন্তত ধর্মমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাস সমৃদ্ধ হতো। একটি সত্য কথা না বললে নয়। আলেম-ওলামারা বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও দলটি ক্ষমতায় গিয়ে তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়। বিএনপি হাইকমান্ডের আশপাশে ক্ষমতাধর যেসব নেতা ছিলেন, তারা অনেকেই দ্বীনদরদি ছিলেন না; বরং অনেকে ছিলেন কট্টর সেক্যুলার ও মনেপ্রাণে কমিউনিস্ট।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অমায়িক, বন্ধুবৎসল ও সাদা মনের মানুষ। ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ ও বিনয়ের মহৎ গুণে অপরাপর ব্যক্তি থেকে তাকে আলাদাভাবে চেনা যায়। রুটিনমাফিক জীবন পরিচালনায় ছিলেন অভ্যস্ত। ফরজ-ওয়াজিবের পাশাপাশি নফল ইবাদতের প্রতি তার বিমোহন লক্ষ করার মতো। নিয়মিত পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও অজিফা তাকে তন্ময় এবং আবিষ্ট করে রাখত। সুগভীর চেতনা ও বিস্তৃত উপলব্ধি দিয়ে তিনি জীবনকে অবলোকন করেন।
কিশোরগঞ্জের মাটি বহু সোনার মানুষ তৈরি করেছেন হজরত মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.) তাদের মধ্যে অন্যতম। তার কর্ম ও কীর্তির মধ্যে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমরা তার অভাব অনুভব করছি প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি মুহূর্তে। আমরা এই মনীষীর স্মৃতির প্রতি অনুপম শ্রদ্ধা নিবেদন করি এবং প্রার্থনা করি যেন আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের উচ্চাসনে অভিষিক্ত করেন, আমিন।
আমার দেশের সৌজন্যে