কক্স২৪ নিউজ বানিজ্যিক বার্তা ডেস্ক।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণসহ সামগ্রিক আর্থিক শৃঙ্খলা আনয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ব্যাংকিং সেক্টর সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় প্রাথমিক পর্যায়ে তফসিলি ব্যাংকসমূহের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নিরূপণের নিমিত্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান - KPMG (Sri Lanka) এবং EY (Sri Lanka) নিয়োগের মাধ্যমে সংকটাপন্ন ছয়টি তফসিলি ব্যাংকের (ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, এক্সিম ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিঃ) সম্পদের গুণগত মান (Asset Quality Review) যাচাই করা হয়।
উক্ত Asset Quality Review মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী উল্লিখিত ব্যাংকসমূহের বিশাল অংকের শ্রেণিকৃত ঋণ/বিনিয়োগ এবং মূলধন ঘাটতি থাকায় বর্ণিত ছয়টি ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটি ব্যাংককে মার্জার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারি মালিকানায় শরীয়াহ্ভিত্তিক একটি ইসলামি ব্যাংক স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছে (সংলাপ-১)। তবে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক পিএলসি-এর শেয়ার মালিকানা বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলমান থাকায় আইসিবি ইসলামী ব্যাংককে উক্ত প্রক্রিয়ার আওতা বহির্ভূত রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিগত এক বছরের অধিক সময় ধরে তারল্য সহায়তা প্রদান করা সত্ত্বেও উক্ত ব্যাংকসমূহের আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি; বরং তাদের তারল্য সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। উক্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি, শ্রেণীকৃত বিনিয়োগ/ঋণ ও অগ্রিমের হার, প্রভিশন ঘাটতি এবং তারল্য সংকট এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, তাদের আমানতকারী ও অন্যান্য পাওনাদারগণের প্রদেয় পাওনা পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরী হচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
উল্লিখিত পাঁচটি ব্যাংক আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকায় আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, আমানতকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিমিত্ত টেকসই ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ (সংলাপ-২) অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতের এ পাঁচটি সংকটাপন্ন ব্যাংক-কে অতিসত্বর রেজল্যুশন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা আবশ্যক। এতদুদ্দেশ্যে প্রাথমিকভাবে একটি নতুন ব্যাংক স্থাপন করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর অনুযায়ী রেজল্যুশনের অধীন উক্ত ৫টি তফসিলী ব্যাংক "হস্তান্তরকারী ব্যাংক" এবং সরকার কর্তৃক স্থাপিতব্য নতুন ব্যাংকটি "হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংক" হিসেবে গণ্য হবে। প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকটি বাণিজ্যিকভাবে ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে।
উল্লেখ্য যে, উক্ত ৫টি সংকটাপন্ন ব্যাংক-কে একটি শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র-মালিকানাধীন ব্যাংক গঠনের মাধমে একীভূতকরণ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে Simulation Exercise এর ভিত্তিতে আগামী ১০ বছর মেয়াদী একটি ফিন্যান্সিয়াল ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছে (সংলাপ-৩)। প্রস্তাবিত রেজল্যুশন কার্যক্রম বাস্তবায়নের নিমিত্ত সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ৮/৯/২০২৫ তারিখে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয় (সংলাপ-৪)।
এছাড়াও গত ১৬/৯/২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের বিশেষ সভায় উল্লিখিত পাঁচটি শরিয়াহ্ভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকের একীভূতকরণ বিষয়ক 'রেজল্যুশন পরিকল্পনা (স্কীম) ২০২৫' অনুমোদিত হয় (সংলাপ-৫) এবং উক্ত ব্যাংকসমূহকে রেজল্যুশনের আওতায় এনে সরকারি মালিকানায় নতুন একটি ব্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে একীভূত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পরবর্তী সময়ে গত ২৪/৯/২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত ব্যাংকিং সেক্টর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিল (BCMC)-এর সভায় পাঁচটি সংকটাপন্ন ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের রেজল্যুশন প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের লোকসানের দায়ভার বহন করার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক হতে নতুন ব্যাংক স্থাপনের জন্য প্রস্তাব (ব্যবসায়িক পরিকল্পনাসহ) অর্থ বিভাগে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (সংলাপ-৬)।
মার্জার প্রক্রিয়ায় প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকের মধ্যে হস্তান্তরকারী ৫ টি ব্যাংকের সমুদয় সম্পদ ও দায়সহ একীভূত হবে। উক্ত ব্যাংকসমূহ BSEC-তে তালিকাভুক্ত এবং মূলধন বাজারে ব্যাংকগুলোর শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে গত ২৮/৯/২০২৫ তারিখ পর্যন্ত উক্ত ৫ টি ব্যাংকের শেয়ারের অভিহিত মূল্য, বাজার মূল্য ও Net Asset Value (NAV) নিম্নরূপ: (সংলাপ-৭)
১. ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি: প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য (টাকা) ১০; প্রতিটি শেয়ারের বাজার মূল্য শেয়ারপ্রতি (টাকা) ২.২০; Net Asset Value (NAV) -৪৩৮.৮১
২. গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি: প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য (টাকা) ১০; প্রতিটি শেয়ারের বাজার মূল্য শেয়ারপ্রতি (টাকা) ১.৬০; Net Asset Value (NAV) -১১৭.৭২
৩. ইউনিয়ন ব্যাংক লিএলসি: প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য (টাকা) ১০; প্রতিটি শেয়ারের বাজার মূল্য শেয়ারপ্রতি (টাকা) ১.৭০; Net Asset Value (NAV) -২২৪.৯৭
৪. এক্সিম ব্যাংক পিএলসি: প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য (টাকা) ১০; প্রতিটি শেয়ারের বাজার মূল্য শেয়ারপ্রতি (টাকা) ৩.৪০; Net Asset Value (NAV) -৭৫.৭৪
৫. সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিএলসি: প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য (টাকা) ১০; প্রতিটি শেয়ারের বাজার মূল্য শেয়ারপ্রতি (টাকা) ৩.৭০; Net Asset Value (NAV) -২১৩.৫১
উক্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, হস্তান্তরকারী ব্যাংকসমূহের প্রত্যেকটির NAV ঋণাত্বক এবং বিপুল পরিমাণ মূলধন ঘাটতি, মন্দ সম্পদ ও তারল্য সংকট থাকায় সকল দায় ও ঝুঁকি হস্তান্তরগ্রহীতা ব্যাংকের মালিক ও শেয়ারহোল্ডারদের বহন (দায় দ্বারা সীমিত) করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানিয়েছে যে, প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকের ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) কোটি টাকার "অনুমোদিত মূলধনের" বিপরীতে "পরিশোধিত মূলধন" হিসেবে আনুমানিক ৩৫,০০০ (পঁয়ত্রিশ হাজার) কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকটির মূলধন বিষয়ে প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, Bail-in প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীগণের ১৫,০০০ (পনেরো হাজার) কোটি টাকার আমানত মূলধনে রূপান্তর করা যেতে পারে এবং অবশিষ্ট ২০,০০০ (বিশ হাজার) কোটি টাকা সরকার মূলধন হিসেবে প্রদান করতে পারে।
এমতাবস্থায়, উল্লিখিত সংকটাপন্ন ৫ টি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংককে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুযায়ী রেজল্যুশন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে নিম্নোক্ত প্রস্তাব করা হলো:
(ক) ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, এক্সিম ব্যাংক পিএলসি এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এই ৫ টি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক-কে মার্জার বা একীভূতকরণ করা যেতে পারে;
(খ) ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ ও ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর বিধান অনুযায়ী হস্তান্তরকারী ব্যাংকসমূহের মালিক/শেয়ারহোল্ডারদের পাওনা নিষ্পত্তি হবে। তাছাড়া, আইন অনুযায়ী ব্যাংকসমূহের মালিকানা দায় দ্বারা সীমিত। ফলে হস্তান্তরকারী ব্যাংকসমূহের উচ্চ মূলধন ঘাটতি ও NAV ঋণাত্নক থাকায় এ মার্জার প্রক্রিয়ায় মালিক/শেয়ারহোল্ডারগণের কোন দাবী পরিশোধের সুযোগ নেই। তবে ব্যক্তি আমানতকারীগণের জমাকৃত অর্থ ব্যাংক রেজল্যুশন পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিশোধ করা যেতে পারে এবং সে লক্ষ্যে প্রয়োজনে আমানত সুরক্ষা তহবিলের অর্থ ব্যবহার করা যেতে পারে;
(গ) উল্লিখিত ৫ টি ব্যাংকের সকল দায় ও সম্পত্তি গ্রহণ করে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি নতুন শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক স্থাপন করা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে অর্থ বিভাগ সরকারের পক্ষে হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংকের মালিক হবে। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে উক্ত মালিকানা বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা যেতে পারে;
(ঘ) প্রস্তাবিত নতুন শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক স্থাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে সরকার ২০,০০০ (বিশ হাজার) কোটি টাকা মূলধন প্রদান করতে পারে, যার মধ্যে নগদে ১০,০০০ (দশ হাজার) কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট ১০,০০০ (দশ হাজার) কোটি টাকা সুকুক বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধ করা যেতে পারে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীগণের ১৫,০০০ (পনেরো হাজার) কোটি টাকার আমানত Bail-in প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূলধনে রূপান্তর করা যেতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে রেজল্যুশন পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিশোধ করা যেতে পারে;
(ঙ) বিদ্যমান সরকারী মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ন্যায় প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংক (হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংক) গঠন সংক্রান্ত কার্যক্রম (আরজেএসসি নিবন্ধন, ব্যাংক লাইসেন্স গ্রহণ ইত্যাদি) ও পরিচালনা Allocation of Business Among The Different Ministries and Divisions, 1996 এর বিধান অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সম্পাদিত হতে পারে। এছাড়াও ব্যাংকটির কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন হবে;
(চ) উল্লিখিত সংকটাপন্ন ৫ টি ব্যাংকের মন্দ ঋণ, বিনিয়োগ ও সম্পদ পুনরুদ্ধার এবং সার্বিক অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী মালিক, পরিচালনা পর্ষদ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং খেলাপী ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করবে।
উপরোক্ত প্রস্তাবসমূহ Rules of Business, 1996-এর Rule 16 (ix) (a) (b) অনুযায়ী উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ বাকী উল্লাহ
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত