ইসলামিক ডেস্ক।
বছরের বার মাসে ও বিভিন্ন মাসের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন আকৃতি ও প্রকৃতির নামাজ ও সেগুলোর নামে আজগুবি ও উদ্ভট সব ফযীলতের বর্ণনা দিয়ে হাদীস বানিয়েছে জালিয়াতগণ। প্রচলিত ‘বার চাঁদের ফযীলত’ জাতীয় গ্রন্থগুলো এ সব বাতিল কথায় ভরা। আমি এই লিখাতে মহার্রাম মাস এর বিষয়ক বিশুদ্ধ ও বানোয়াট হাদীস, নামাজ, রোজা, অন্যান্য আমল ও ফযীলতের কথা উল্লেখ করব। আল্লাহর তাওফীক চাই।
☆ মুহাররাম মাস:
▪ কোরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের আলোকে মুহার্রাম মাস
আরবী পঞ্জিকার প্রথম মাস মুহাররাম। আমরা এ মাসের ফযীলত সম্পর্কে নিম্নের বিষয়গুলো জানতে পারি:
১.বৎসরের চারটি ‘হারাম’ মাস,যথা- মুহার্রাম, রজব, যিলকাদ ও যুলহাজ্জ মাস। এ মাসগুলো ইসলামী শরীয়তে বিশেষভাবে সম্মানিত। এগুলোতে ঝগড়াঝাটি বা যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ।
اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللّٰهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِیْ كِتٰبِ اللّٰهِ یَوْمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِكَ الدِّیْنُ الْقَیِّمُ ۬ فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُمْ.
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারটি, তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এ নিষিদ্ধ মাসগুলোর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।[সূরা তওবা-৩৬]
উক্ত আয়াতে চারটি নিষিদ্ধ মাসের কথা উল্লেখ রয়েছে। আর রাসূল সা.তার হাদীসে এই চারটি মাস কোনগুলি তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। যথা-
عَنْ ابْنِ أَبِيْ بَكْرَةَ عَنْ أَبِيْ بَكْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ الزَّمَانَ قَدْ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللهُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ثَلَاثٌ مُتَوَالِيَاتٌ ذُو الْقَعْدَةِ وَذُو الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمُ وَرَجَبُ مُضَرَ الَّذِيْ بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ.
আবূ বাকরা রা.থেকে বর্ণিত,নবী সা.হতে বর্ণিত। তিনি বললেন, আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেন সেদিন যেভাবে যামানা ছিল তা আজও তেমনি আছে। বারমাসে এক বছর, তার মধ্যে চার মাস পবিত্র। যার তিন মাস ধারাবাহিক যথা যিলকাদ, যিলহাজ্জ ও মুর্হারম আর মুযার গোত্রের রাজব যা জামাদিউস্সানী ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী। [বুখারী-৪৬৬২,মুসলিম-১৬৭৯]
২. এ মাসকে হাদীসে ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এ মাসের নফল রোজা সর্বোত্তম নফল রোজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
عن أبي هريرة رضي الله عنه يرفعه -سُئِلَ [أي النبي صلى الله عليه وسلم] أَيُّ الصَّلَاةِ أَفْضَلُ بَعْدَ المَكْتُوبَةِ؟ وَأَيُّ الصِّيَامِ أَفْضَلُ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ؟ فَقالَ: أَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ المَكْتُوبَةِ الصَّلَاةُ في جَوْفِ اللَّيْلِ، وَأَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ صِيَامُ شَهْرِ اللهِ المُحَرَّمِ.
আবূ হুরায়রাহ রা.হতে বর্ণিত,রাসূল সা. হতে প্রশ্ন করা হলো ফরজ নামাজের পরে কোন নামাজ,আর ফরজ রোজার পরে কোন রোজা উত্তম? উত্তরে রাসূল সা. বলেন ফরয নামাজ পরে সর্বোত্তম নামাজ হল রাতের নফল বা তাহাজ্জুদের নামাজ।
রমজানের পরে সর্বোত্তম রোজা হল মুহাররম মাসের রোজা।[মুসলিম-১১৬৩]
৩. এ মাসের ১০ তারিখ ‘আশূরা’র দিনে রোজা পালনের বিশেষ ফযীলত রয়েছে।
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، رضى الله عنهما أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَدِمَ الْمَدِينَةَ فَوَجَدَ الْيَهُودَ صِيَامًا يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ مَا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِي تَصُومُونَهُ. فَقَالُوا هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ أَنْجَى اللَّهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُومُهُ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ. فَصَامَهُ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ
ইবনে আব্বাস রা.থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,রাসূল ﷺ মদীনায় এসে দেখলেন যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন দিন যে তোমরা রোজা পালন করছ? তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ মুছা আ.ও তার সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন মুছা আ. শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে রোজা পালন করেছেন। এ কারণে আমরাও রোজা পালন করে থাকি। এ কথা শুনে রাসূল ﷺ বললেন,তোমাদের চেয়ে আমরা মুছা আ.এর অধিকতর ঘনিষ্ট ও নিকটবর্তী। অতঃপর রাসূল ﷺ রোজা পালন করলেন ও অন্যদেরকে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন।[মুসলিম- ১১৩০]
◇ বুখারীর বর্ণনায় আছে, هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ এটি একটি ভাল দিন।[বুখারী-৩৩৯৭]
◇এই দিন নূহ আ.এর কিশতি জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল।[বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্ত ফতহুল বারী]
◇ ইমাম আহমাদ সামান্য বর্ধিতাকারে উক্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন। যেখানে আছে,
وهو اليوم الذي استوت فيه السفينة على الجودي فصامه نوح شكراً
এটি সেই দিন যাতে নূহ আ.এর কিশতি জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল, তাই নূহ আ. আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ার্থে সেদিন রোজা রেখেছিলেন।[ফাতহুল বারী ৫/৪৩৯]
◇ এই দিনের অপেক্ষা করতেন রাসূল ﷺ
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَتَحَرَّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضَّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إِلاَّ هَذَا الْيَوْمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَهَذَا الشَّهْرَ يَعْنِي شَهْرَ رَمَضَانَ
ইবনু আব্বাস রা.থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,আমি রাসূল সা.কে ‘আশূরার দিনের সওমের উপরে অন্য কোন দিনের সওমকে প্রাধান্য প্রদান করতে দেখিনি এবং এ মাস অর্থাৎ রমযান মাস (এর উপর অন্য মাসের গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখিনি)।[বুখারী-২০০৬]
☆ এই দিনের রোজায় এক বছরের গোনাহ থেকে মুক্তিলাভ হয়.
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ
আবূ কাতাদাহ রা.থেকে বর্ণিত,রসূল সা. বলেছেন-আশূরার দিনের রোযার দ্বারা আমি আল্লাহর নিকট বিগত বছরের গুনাহ মাফের আশা রাখি।[মুসলিম- ১১৬২,তিরমিযী ৭৫২,আবূ দাউদ-২৪২৫, ইবনে মাজা-১৭৩৮]
☆ আশুরার সাথে তাসুআ তথা নবম তারীখের রোজাও মুস্তাহাব।
عَبْدَ اللَّهِ، بْنَ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما يَقُولُ حِينَ صَامَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ. قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم.
আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা.থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সা.যখন আশূরা (আশুরা)র দিন সিয়াম পালন করেন এবং লোকদেরকে সিয়াম পাননের নির্দেশ দেন তখন সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইয়াহূদী এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসুল সা.বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও সিয়াম পালন করব। বর্ণনাকারী বলেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় রাসুল সা.এর ইনতেকাল হয়ে যায়।[মুসলিম-১১৩৪]
★অত্যন্ত দুর্বল হাদীস ও সাহাবী- তাবিয়ীগণের বক্তব্য:
বিশুদ্ধ হাদীস থেকে মুহার্রাম মাস ও আশুরা সম্পর্কে শুধু এতটুকুই জানা যায়, যতটুকু উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরবর্তীকালে অনেক বানোয়াট ও মিথ্যা কাহিনী এক্ষেত্রে প্রচলিত হয়েছে। এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়:
• প্রথম বিষয়: এ দিনটিকে ইহূদীগণ সম্মান করত। এ কারণে ইহূদীদের মধ্যে এ দিনটি সম্পর্কে অনেক ভিত্তিহীন কল্প- কাহিনী প্রচলিত ছিল। পরবর্তী যুগে ইসরাঈলী রেওয়ায়াত হিসাবে সেগুলো মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। প্রথম যুগে মুসলিমগণ এগুলো সত্য বা মিথ্যা বলে বিশ্বাস না করে ইসরাঈলী কাহিনী হিসাবেই বলেছেন। পরবর্তী যুগে তা ‘হাদীসে’ পরিণত হয়েছে।
• দ্বিতীয় বিষয়: রাসূল ﷺ-এর ইন্তিকালের অর্ধ শতাব্দী পরে ৬১ হিজরীর মুহার্রাম মাসের ১০ তারিখে আশূরার দিনে তাঁর প্রিয়তম নাতি হুসাইন রা.কারবালার প্রান্তরে শহীদ হন। এ ঘটনা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। হুসাইন রা.এর পক্ষের ও বিপক্ষের অনেক বিবেকহীন দুর্বল ঈমান মানুষ ‘আশূরার’ বিষয়ে অনেক ‘হাদীস’ বানিয়েছে। কেউ দিনটিকে ‘শোক দিবস’ হিসেবে এবং কেউ দিনটিকে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য নানা প্রকারের কথা বানিয়েছেন। তবে মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতিতে এ সকল জালিয়াতি ধরা খুবই সহজ ছিল।
□ মুহার্রাম ও আশূরা সম্পর্কে এজাতীয় প্রচলিত কথাবার্তাকে আমরা দু ভাগে ভাগ করতে পারি:
১.যে সকল ‘হাদীস’ কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল বা বানোয়াট বলে উল্লেখ করলেও, কেউ কেউ তা দুর্বল হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং যে সকল ‘হাদীস’ অত্যন্ত দুর্বল সনদে কোনো কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। বাহ্যত ইসরাঈলী বর্ণনার ভিত্তিতে তাঁরা এগুলি বলেছেন।
২.সকল মুহাদ্দিস যে সকল হাদীসকে ‘জাল’ ও ভিত্তিহীন বলে একমত পোষণ করেছেন। এখানে আমরা প্রথম পর্যায়ের কিছু হাদীস ও মতামত উল্লেখ করছি:
• মুহার্রাম মাসে বা আশূরার দিনে দান- সাদকার বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। রাসূল ﷺ থেকে এ বিষয়ে কিছুই বর্ণিত হয় নি। তবে অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য সূত্রে একজন সাহাবী রা.থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আশুরার দিনে সিয়াম পালন করলে যেহেতু এক বছরের সাওয়াব পাওয়া যায়, সেহেতু এ দিনে দান করলেও এক বছরের দানের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া এ দিনে দানের বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও ভিত্তিহীন কথা।[ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৭৮; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৫-৯৬]
#যে দূর্বল হাদীস বর্নাণা করে থাকে তা হচ্ছে -
مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ فِيْ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ، وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ فِيْ سَنَتِهِ كُلِّهَا[مسائل أحمد رواية ابن هانيء: 1/136]
যে ব্যক্তি আশূরার দিনে তার পরিবারের জন্য প্রশস্তভাবে খরচ করবে, আল্লাহ সারা বছরই সে ব্যক্তিকে প্রশস্ত রিযিক প্রদান করবেন।
হাদীসটি কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি সনদই অত্যন্ত দুর্বল। বিভিন্ন সনদের কারণে বাইহাকী, ইরাকী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘জাল’ হিসেবে গণ্য না করে ‘দুর্বল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে ‘অত্যন্ত আপত্তিকর ও খুবই দুর্বল’ বলেছেন। অপরদিকে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইবনু তাইমিয়া প্রমুখ মুহাদ্দিস একে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন যে, প্রত্যেক সনদই অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার ফলে একাধিক সনদে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় না। এছাড়া হাদীসটি বিশুদ্ধ হাদীসের বিরোধী। বিশুদ্ধ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদীরা আশুররা দিনে উৎসব-আনন্দ করে তোমরা তাদের বিরোধিতা করবে, এ দিনে সিয়াম পালন করবে এবং উৎসব বা আনন্দ করবে না।[ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুস্সাস, পৃ. ৭৯, ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/১১৩-১১৭; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৯-২১৩; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪২৭; আল-যারকশী, আত-তাযকিরা ৩৪, ১১৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৫০-১৫৭; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৭৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৪৪-২৪৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৩২-১৩৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১০০-১০২]
من وسَّعَ على عيالِهِ يومَ عاشوراءَ وسَّعَ اللَّهُ عليهِ سائرَ سَنتِهِ.
خلاصة حكم المحدث : غير محفوظ فلا يثبت هذا عن رسول الله صلى الله عليه وسلم في حديث مسند.[العلل المتناهية: 2/553]
• আশূরার দিনে চোখে সুরমা ব্যবহার করার তাগিদ।
مَنِ اكْتَحَلَ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ بِالإِثْمِدِ، لَمْ تَرْمُدْ عَيْنُهُ أَبَداً[رواه ابن الجوزي في الموضوعات]
যে ব্যক্তি আশূরার দিনে চোখে ‘ইসমিদ’ সুরমা ব্যবহার করবে কখনোই তার চোখ উঠবে না।
উপরের হাদীসটির মতই এ হাদীসটি একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক সনদেই অত্যন্ত দুর্বল বা মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে হাদীসটিকে ‘দুর্বল’ হিসাবে গণ্য করলেও অধিকাংশ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল ও বানোয়াট হিসাবে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন, ইমাম হুসাইনের হত্যাকারীগণ আশুরার দিনে সুরমা মাখার বিদআতটি চালু করেন। এ কথাটি তাদেরই বানানো। কোনো দুর্বল রাবী বেখেয়ালে তা বর্ণনা করেছেন।[ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/১১৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/২১১; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪০১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৫৭; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৭৯; মোল্লা কারী, আল- আসরার, পৃ. ২২২; মাসনূ, পৃ. ১৪১; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৩১-১৩২; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১০০-১০২।]
□ মুহাররাম মাস বিষয়ক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা:
উপরের কথাগুলো কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল বলে গণ্য করলেও কেউ কেউ তা ‘দুর্বল’ বলে গণ্য করেছেন। নিচের কথাগুলো সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে জাল বলে স্বীকার করেছেন। এগুলোকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি:
○ প্রথম-মুহার্রাম বা আশুরার সিয়ামের ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা,
○ দ্বিতীয়-আশুরার দিনের বা রাতের জন্য বা মুহার্রম মাসের জন্য বিশেষ নামাজ ও তার ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা এবং
○ তৃতীয়-আশুরার দিনে অতীত ও ভবিষ্যতে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে বলে জাল কথা।
১. মুহার্রাম বা আশূরার সিয়াম
আশুরার সিয়াম পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহের কাফফারা হবে বলে বিশুদ্ধ হাদীসে আমরা দেখতে পেয়েছি। জালিয়াতগণ আরো অনেক কথা এ সম্পর্কে বানিয়েছে। প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি:
▪ হাদীসে আছে- যে ব্যক্তি মহররমের মাসে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তাহাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ৩০ দিন রোযা রাখার সমান ছওয়াব দিবেন।
▪ আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার দিন একটি রোযা রাখিবে সে দশ হাজার ফেরেশতার, দশ হাজার শহীদের ও দশ হাজার হাজীর ছওয়াব পাইবে।
▪ আরও হাদীছে আছে-যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে স্নেহ-পরবশ হয়ে কোন এতীমের মাথায় হাত ঘুরাবে, আল্লাহ ঐ এতীমের মাথার প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে তাহাকে বেহেশতের এক একটি ‘দরজা’ প্রদান করিবেন।
▪ আর যে ব্যক্তি উক্ত তারিখের সন্ধ্যায় রোযাদারকে খানা খাওয়াবে বা ইফতার করাবে, সে ব্যক্তি সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীকে খানা খাওয়াইবার ও ইফতার করাবার ন্যায় ছওয়াব পাবে।
▪ রাসূল ﷺ আরও বলিলেন, যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে রোযা রাখিবে, সে ৬০ বৎসর রোযা নামায করার সমতুল্য ছওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি ঐ তারিখে বিমার পোরছী করবে, সে সমস্ত আওলাদে আদমের বিমার-পোরছী করার সমতুল্য ছওয়াব পাবে। তাহার পরিবারের ফারাগতি অবস্থা হবে। ৪০ বৎসরের গুনাহর কাফফারা হয় যাবে।[মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ৪৩০-৪৩১। পুনশ্চ: মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ২৯৮-৩০০]
▪ অনুরূপ আরেকটি মিথ্যা কথা: রাসূল ﷺ এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা রাখিবে, সে ব্যক্তি যেন ১০ হাজার বৎসর যাবত দিনের বেলা রোজা রাখিল এবং রাত্রিবেলা ইবাদতে জাগরিত থাকিল। মহররম মাসে ইবাদতকারী ব্যক্তি যেন ক্বদরের রাত্রির ইবাদতের ফযীলত লাভ করিল। তোমরা আল্লাহর পছন্দনীয় মাস মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিও। যেই ব্যক্তি মহররম মাসের সম্মান করিবে, আল্লাহ তাহাকে জান্নাতের মধ্যে সম্মানিত করিবেন এবং জাহান্নামের আযাব হইতে বাঁচাইয়া রাখিবেন,মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখা আদম আ.ও অন্যান্য নবীদের উপর ফরজ ছিল। এই দিবসে ২০০০ নবী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং ২০০০ নবীর দোয়া কবুল করা হইয়াছে।[মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩]
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এগুলো সবই বানোয়াট কথা ও জাল হাদীস।
[ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/১১২-১১৭; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৮-১০৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৯-১৫১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৯৪; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৯-১৩০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৪-৯৫]
২. মুহার্রাম মাসের নামাজ:-
মুহার্রাম মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে এবং আশুরার দিবসে বা রাত্রে কোনো বিশেষ নামাজ আদায়ের কোনো প্রকার নির্দেশনা বা উৎসাহ কোনো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে বলে আমার জানা নাই। এ বিষয়ক সকল কথাই বানোয়াট। আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো পুস্তকে মুহার্রাম মাসের ১ম তারিখে দুই রাকআত নামাজ আদায় করে বিশেষ দোয়া পাঠের বিশেষ ফযীলতের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।[মুফতী হাবীব ছামদানী,বার চান্দের ফযীলত-পৃ.১১-১২; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, নেক কানুন, পৃ. ২৯৮।]
৩. আশুরার দিনে বা রাতে বিশেষ নামাজ:
আশুরার রোজার উৎসাহ দেয়া হলেও, হাদীসে আশুরার দিনে বা রাত্রে কোনো বিশেষ নামাজ আদায়ের বিধান দেওয়া হয় নি। তবে জালিয়াতগণ অনেক কথা বানিয়েছে। যেমন, যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে অথবা আশুরার রাত্রিতে এত রাকআত নামাজ অমুক অমুক সূরা এতবার পাঠ করে আদায় করবে সে এত পুরস্কার লাভ করবে। সরলপ্রাণ মুসলিমদের মন জয় করার জন্য জালিয়াতগণ এ সকল কথা বানিয়েছে, যা অনেক সময় সরলপ্রাণ আলিম ও বুযুর্গকেও ধোঁকা দিয়েছে।[ইবনুল জাওযী, মাওদূ‘আত ২/৪৫-৪৬; সুয়ূতী, লাআলী ২/৫৪; ইবন আর্রাক, তানযীহ ২/৮৯; শাওকানী, আল- ফাওয়াইদ ১/৭৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯০, ১১০-১১১]
৪. আশুরায় অতীত ও ভবিষ্যত ঘটনাবলির বানোয়াট ফিরিস্তি।
মিথ্যাবাদীরা রাসূল ﷺ এর নামে জালিয়াতি করে বলেছে:
এ দিনে মুহাম্মাদ ﷺ জন্মগ্রহণ করেছেন।
কেউ কেউ বানিয়েছে।
মুহার্রামের ২ তারিখে নূহ আ.প্লাবন হতে মুক্তি পেয়েছেন,
৩ তারিখে ইদরীসকে আ. আসমানে উঠানো হয়েছে,
৪ তারিখে ইবরাহীমকে আ.অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরূপ অগণিত ঘটনা এ মাসে বা এ দিনে ঘটেছে এবং ঘটবে বলে উল্লেখ করেছে জালিয়াতরা তাদের এ সকল কল্প কাহিনীতে। মোট কথা হলো, আশুরার দিনে মূসা আ.ও তাঁর সাথীদের মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো ঘটনা বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। আদম আ.এর তাওবা কবুল, নূহ আ.এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামা ও ঈসা আ. জন্মগ্রহণ করার কথা অনির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী থেকে বর্ণিত।
আশুরা বা মুহার্রাম সম্পর্কে আর যা কিছু বলা হয় সবই মিথ্যা ও বাতিল কথা। দুঃখজনক হলো, আমাদের সমাজে মুহার্রাম বা আশূরা বিষয়ক বই পুস্তকে, আলোচনা ও ওয়াযে এ সমস্ত ভিত্তিহীন কথাবার্তা উল্লেখ করা হয়।[ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১১২-১১৭; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ৫২; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/১৯০; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ২/১৬৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৮-১০৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩০০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৪-৯৭; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৭৭-২৭৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫৫৭]
আল্লাহ আমাদেরকে ফরয বিধানের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন থাকার পাশাপাশি নফল বিধানাবলির ক্ষেত্রেও মনোযোগী হওয়ার তাওফীক দান করুন।
বিশেষভাবে নতুন বছরে নতুন প্রত্যয় ও পূর্ণ উদ্যমে ঈমান-আমলের পথে এগিয়ে যাবার তাওফীক দান করুন। আমাদের ঈমান-আমল, কর্ম-আচরণ, স্বভাব- চরিত্রসহ জীবনের সকল অঙ্গনে উৎকর্ষ আসুক-এই পণ নিয়ে শুরু হোক আমাদের আগামীর পথচলা। আল্লাহ সকলকে সেই তাওফীক দান করুন- আমীন।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ বাকী উল্লাহ
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত