নিউজ ডেস্ক।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের এক অনন্য জনপদ – ধলঘাটা। এটি কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত মহেশখালী উপজেলার একটি ঐতিহাসিক ও সমৃদ্ধ ইউনিয়ন, যার বুকে লুকিয়ে আছে প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের ইতিহাস। এই জনপদ শুধু প্রকৃতি আর সাগরের কোলেই বেড়ে ওঠেনি, বরং এখানে রয়েছে সংগ্রাম, সংস্কৃতি, ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং গ্রামীণ জীবনধারার এক অনন্য চিত্র।
ধলঘাটার ইতিহাসের সূচনা আনুমানিক ১৭শ শতকের মাঝামাঝি। তখন উপকূলীয় বঙ্গদেশে সামুদ্রিক জলদস্যুদের উৎপাত থাকলেও কিছু সাহসী জনগোষ্ঠী এসে এই দ্বীপনগরীতে বসতি স্থাপন করে। তারা কৃষি, মাছ ধরা ও লবণ উৎপাদনকে জীবিকার ভিত্তি করে একটি সমাজ গড়ে তোলে। ধীরে ধীরে এই অঞ্চল একটি স্বনির্ভর জনপদে পরিণত হয়।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, এক সময় ধলঘাটা ছিল হিন্দু জমিদার ও বাঙালি মুসলিম বসতির মিলনস্থল। এখানকার মন্দির, পুরোনো কুয়া, মসজিদ ও ভাঙা সড়ক আজও সে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলবর্তী দ্বীপাঞ্চল মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়ন—একটি জনপদ, যেখানে প্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নেয় মানুষের সহ্যশক্তি, ধৈর্য ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। ধলঘাটা শুধু নামেই নয়, বাস্তবেই এক 'ধলা' ভূমি—যেখানে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, নদীভাঙন, এমনকি বর্ষার সময় দীর্ঘদিন জোয়ারের পানিতে পানিবন্দি থাকার মতো দুর্যোগ যেন নিত্যসঙ্গী।
ষাটের দশকে ধলঘাটার বুক চিরে নেমে এসেছিল এক ভয়ংকর বন্যা। চারদিক জলমগ্ন, ধান-চাল ভেসে গেছে, মাছের ঘের ভেসে উঠেছে, মানুষ গবাদি পশুসহ ছুটেছে উঁচু জায়গার খোঁজে কিন্তুু পায়নি। এই ভয়াবহতা ধলঘাটার মানুষকে আশান্বিত করতে পারেনি।প্রতিজ্ঞা করেছিলো মা মাটি ছেড়ে যাবেনা। বাঁশ, কঞ্চি, কাদামাটি আর ভালোবাসা দিয়ে গড়া হয়েছিল নতুন ঘর।
সময়টা ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। ধলঘাটার মানুষ সাক্ষী হয় ৯০ দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের। রাতের আঁধারে মৃত্যুর মিছিল, ঘরবাড়ি লণ্ডভণ্ড, লাশে ছেয়ে গিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। কিন্তু তবুও এখানকার মানুষের হৃদয়ে ছিল একটাই শব্দ — "শিকড় ছাড়া যাবে না!"
তারা মৃতদের কাঁধে তুলে শেষ বিদায় দিয়ে আবারও ফিরেছে জীবনের মঞ্চে।
১৯৯৭ সাল ধলঘাটাকে আবারও তছনছ করে দিয়ে যায় এক দুর্দান্ত জলোচ্ছ্বাস। সমুদ্রের পানি ঢুকে পড়ে জনপদে, মাঠঘাট সব হারিয়ে যায় এক রাতেই, বাতাসের তীব্রতা ঘর বাড়ি তচনচ করে দিয়ে গেছে । মানুষের কান্না যেন মিলিয়ে যায় গর্জনরত ঢেউয়ের শব্দে। কিন্তু আশ্চর্য, ধলঘাটা আবারও জেগে ওঠে। যে মাটি একদিন লাশ চাপা দিয়েছিল, সেই মাটিতেই আবারও ফলেছিল লবণ, চিংড়ি, শুটকীর মতো অর্থকরী ফসল।
ধলঘাটা ইউনিয়নের মানুষ সহজে হার মানার নয়। শত প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ও অবহেলার মাঝেও তারা গড়ে তুলেছে টিকে থাকার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রতিটি ঝড়ের পরদিন সূর্য উঠেছে ধলঘাটার আকাশে আর সেই সূর্যই জুগিয়েছে নতুন দিনের প্রেরণা।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর কেটে গেছে। বাংলাদেশ এগিয়েছে—শহর জুড়ে আলো, সড়কে আধুনিক যান, শিক্ষায় প্রযুক্তির ছোঁয়া। কিন্তু কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নের চিত্র এখনো অনেকটাই সেই পুরনো দিনের মতোই রয়ে গেছে।
লোভ দেখানো উন্নয়নের কথা আজ নাই বললাম।
আজ এতদিন পর ধলঘাটা ইউনিয়নের ভাগ্য পরিবর্তনের সময় এসেছে। এক সময় যেই জনপদ ছিল অবহেলার প্রতীক, যেখানে সরকারি উন্নয়ন মানেই ত্রাণের কার্ড আর ভাঙাচোরা রাস্তা মেরামতের আশ্বাস—আজ সেই ধলঘাটায়
নির্মিত হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর (ডিপ সি পোর্ট) যা জাতীয়ভাবে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এক সময়কার নিঃশব্দ জনপদ আজ পরিণত হচ্ছে সম্ভাবনার শিল্পাঞ্চলে।
অথচ আজ সেই গভীর সমুদ্র বন্দরের নামটিই পাশের ইউনিয়নের নামে বদলে দেওয়া হয়েছে, যেন ইচ্ছেমতো ইতিহাস মুছে ফেলার এক ভয়ানক চেষ্টা! এর বিরুদ্ধে কোথায় ছিলো তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের কণ্ঠস্বর? কেউ কি বলেছে, “না, আমরা এর প্রতিবাদ করি?” না, বরং তারা ব্যস্ত ছিলেন ওয়ার্ড সংশোধনের মামলার নামে নিজেদের চেয়ার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার লোভ লালসায়।
এরই ফাঁকে মাঠে নামে ভূমি অফিসের কিছু দালালচক্র। তারা শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষদের ভুল বুঝিয়ে, নানা রকম আইনি ভয় দেখিয়ে বা লোভের ফাঁদে ফেলে নামমাত্র মূল্যে বাস্তুভিটা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। কোনো এক অদৃশ্য শক্তির ছায়ায় তারা এগোচ্ছে — যেন ধলঘাটার গরীব মানুষের জমি তাদের চোখে কেবলই “সুযোগ”।
সময় এসেছে রুখে দাঁড়াবার।
আমরা যারা এই মাটির সন্তান, আমাদের এখনই সংগঠিত হতে হবে। এই অন্যায়, এই দালালি, এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ধলঘাটা জেগে উঠবে — এটাই ইতিহাসের দাবি।
আপনার নীরবতা যেন ষড়যন্ত্রকারীদের সাহস না হয়ে দাঁড়ায়।
ধলঘাটার জন্য, আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য, প্রতিবাদ হোক—একেকজন একেক জায়গা থেকে। হোক ভিন্ন ব্যানারে , কিন্তু লক্ষ্য হোক একটাই—
ধলঘাটার অস্তিত্ব রক্ষা।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ বাকী উল্লাহ
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত